নীরবে বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি জনপদ

কেউ একবেলা, আবার কেউ পরিবার নিয়ে না খেয়েই কাটিয়ে দিতেন পুরো দিন। অভাব-অনটনের সংসারে ছিল না শিক্ষার আলো। সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে জীবনমান। সংসারে ফিরেছে সুদিন। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে সন্তানরা। বলছিলাম ঘাটাইল উপজেলার অবহেলিত পাহাড়ি জনপদের কথা।

সাগরদীঘি, লক্ষিন্দর, দেওপাড়া, সন্ধানপুর, রসুলপুর ও ধলাপাড়া ইউনিয়ন টিলা এলাকা। এক সময় এলাকাগুলো ছিল অবহেলিত। এখানকার মানুষ খেয়ে না খেয়ে পার করতেন তাদের জীবন। ছিল না কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। শিক্ষার হার ছিল সর্বনিম্ন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল একেবারেই নাজুক। এক যুগের ব্যবধানে ঘটে গেছে শিল্প বিপ্লব। দিন দিন বাড়ছে শিল্পের প্রসার। ঘাটাইলের কারখানাগুলোর বেশির ভাগ সাগরদীঘি, লক্ষিন্দর ও রসুলপুর ইউনিয়নে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে হয়েছে বহু মানুষের কর্মসংস্থান। এখানকার মানুষের আগের মতো দুঃখ-কষ্ট নেই। এখন উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঘরে খাবারের অভাব আর নেই। শিশুরা এখন আর ঘরের কোণে আবদ্ধ থাকে না। প্রতিদিন নিয়ম করে বই-খাতা নিয়ে ছুটে চলে স্কুলে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে তারা। দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে এই জনপদ।

স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম জানান, কোম্পানিগুলো তাদের প্রয়োজনে রাস্তা পাকা করে নিয়েছে। ফলে জনসাধারণের আর কাঁচা রাস্তার দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।

ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শ্রম শক্তিসহ বিভিন্ন কারণে উপজেলার পূর্বাঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার অবারিত সুযোগ রয়েছে। এসব সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বেশ 
কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান। উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্যমতে, নতুন করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য সম্প্রতি ১০টি নামকরা শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের কেনা জমির নামজারি করার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে– রেনেটা লিমিটেড, কাজী পলিমার লিমিটেড, স্বর্ণালী এগ্রো কম্পোজিট লিমিটেড, আইসোটেক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, ভিকার কংক্রিট প্রোডাক্টস লিমিটেড, বেস্ট স্ট্রাকচারাল স্টিল লিমিটেড, পিপলস পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড ও বেস্ট মিক্স বিডি। এসব প্রতিষ্ঠান নতুন কারখানা করলে হাজারও মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ব্যবসারও প্রসার ঘটবে।

স্থানীয়রা জানান, রাজধানীর আশপাশের এলাকার তুলনায় ঘাটাইলে জমির দাম অনেক কম। পাওয়া যায় ব্যক্তি মালিকানা বড় আকারের খালি জমি। রয়েছে খাস জমিও। আছে ইজারা নেওয়ার সুযোগ। তাই কোম্পানিগুলোর আগ্রহে ভাটা পড়ার কোনো কারণ দেখা যায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ঘাটাইলের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। দূরত্ব একটু বেশি হলেও ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালো। এখানে চলমান রয়েছে প্যারাগন কোম্পানি। যেখানে উৎপাদিত হয় মুরগির ডিম ও জৈবসার। প্যারাগন কর্তৃপক্ষ জানান, প্রতিদিন প্রায় দেড়শ লোক কাজ করেন তাদের কোম্পানিতে। পিপলস কোম্পানি রয়েছে তিনটি। তারা উৎপাদন করে ডিম, মুরগির খাদ্য, মাছের খাদ্য ও মুরগির বাচ্চা। নারিশ কোম্পানি রয়েছে পাঁচটি। তাদের চারটিতে মুরগির বাচ্চা ও একটিতে হয় ডিম উৎপাদন। ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে তাইওয়ানের প্রতিষ্ঠান সিপি রয়েছে সাতটি। রয়েছে দুটি বল্ক কারখানা। যেখানে ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্ট-বালু দিয়ে তৈরি হয় ব্লক। গাজীপুরের পরেই পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি তৈরির সবচেয়ে বড় কারখানা পূর্ব ঘাটাইলে। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানান, তাদের কারখানায় প্রায় ২০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সিপি কোম্পানি থেকে ব্রয়লার মুরগির বিষ্ঠা কিনে জৈবসার তৈরি করার লোকের সংখ্যাও কম নয়। এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত শতাধিক লোক। পূর্ব ঘাটাইলে রয়েছে একটি ময়দার কারখানা। ধানের কুঁড়া থেকে তেল তৈরির কারখানার সংখ্যা দুটি। এসব কারখানায় কাজ করেন দুই শতাধিক লোক। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের হ্যাচারি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আনাম হ্যাচারি।

বিদ্যুতের খুঁটি তৈরি কারখানার শ্রমিক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আগে মেলা কষ্ট কইরা দিন পার করতাম, এহন সুখেই আছি। পোলা-মেয়াগো লেখাপড়া করাইতে পারছি, এর চাইয়া আর বড় কি অবার পারে।’  

আমিনুলের কথার সত্যতা পাওয়া যায় সানবান্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিমের সঙ্গে কথা বলে। তিনি বলেন, আগে স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম ছিল। বাবার সঙ্গে অনেকেই কাজে চলে যেত। এখন তারা নিয়মিত স্কুলে আসে। প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিমের ভাষ্য, আব্দুল আলিম নামে একজন অভিভাবকের দুই সন্তান তাঁর স্কুলে লেখাপড়া করে। ওই অভিভাবক তিন দিন আগে তাঁকে জানান স্থানীয় একটি কোম্পানিতে কাজ করেন তিনি। মাসে বেতন পান ৩২ হাজার টাকা। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে এখন আর তাঁর কোনো সমস্যা হয় না। পরিবার নিয়ে সুখেই কাটছে দিন।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম জানায়, আগে বাবার সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করত সে। ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারত না। বছর খানেক আগে তার বাবা আমীর আলী একটি কোম্পানিতে কাজ পেয়েছেন। সংসার এখন ভালো চলে। তাই তাকে আর কাজে যেতে হয় না। মন দিয়েছে লেখাপড়ায়। ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা তার।

দুলালিয়া গ্রামের সেলিম মিয়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। ছিলেন ভ্যানচালক। কোনোভাবে টেনে-টুনে চলত তাঁর সংসার। স্থানীয় একজনের পরামর্শে ঋণ করে বাচ্চা উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ডিমের খোসা কিনে তৈরি করা শুরু করেন জৈবসার। এর পর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন তিনিই করেছেন মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাঁর কারখানায় কাজ করেন ১৫ শ্রমিক। সেলিম মিয়ার ভাষ্য, কোম্পানিগুলো তাদের জন্য আশীর্বাদরূপে এসেছে।

পিপলস কোম্পানিতে কাজ করতেন উত্তর লক্ষিন্দর গ্রামের দুলাল আকন্দ। তিনি বলেন, ‘পিপলস কোম্পানি থেকে শিখে মুরগির বিষ্ঠা কিনে শুকিয়ে জৈবসার তৈরি করি। আমার কারখানা রয়েছে। প্রতিদিন ১০০ লোক কারখানায় কাজ করেন। আমার এতদূর আসার পেছনে সব অবদান পিপলস কোম্পানির।’

ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদের ভাষ্য, উপজেলার পূর্ব অঞ্চল আগে খুবই অবহেলিত ছিল বলে লোকমুখে শুনেছেন। যেখানে দুবেলা-দুমুঠো খাবার জোগাড় করা বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে শিক্ষার আলো প্রবেশ করার কথা তো ভাবাই যেত না। তবে ওই এলাকার মানুষ কর্মঠ। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকাই ছিল দারিদ্র্যের মূল কারণ। এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। উন্নত হয়েছে তাদের জীবনমান। প্রবেশ করেছে শিক্ষার আলো। এসবের পেছনে নীরব ভূমিকা পালন করেছে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা শিল্প প্রতিষ্ঠান। এখানে কর্মসংস্থানের বিপ্লব ঘটে গেছে। এখানে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য আরও অনেক কোম্পানি এগিয়ে আসছে। সুযোগ ও সম্ভাবনা দুটোই রয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি।