ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে মানসম্মত জীবন চাইলে...

২০২৫
সালে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মাত্রায় বায়ুদূষণের
কবলে পড়েছে ঢাকা। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট নিয়েই এখানে
আমাদের বসবাস। এটাকে আমরা যেন জাতীয়
নিয়তি ধরে নিয়েছি।
এই বিষাক্ত বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য শহরে।
ছড়িয়ে পড়ছে কলকারখানা ও
বাণিজ্যিক কেন্দ্রের কাছাকাছি গ্রামগঞ্জে। ঢাকার যানজট এবং প্রকৃতিহীনতাও গ্রাস
করছে পুরোনো নগর, উপশহর এবং
অনেক জনপদকে।
এ ছাড়া উজান থেকে
নেমে আসার সময় বাধাগ্রস্ত
হচ্ছে নদ-নদী। বেদখল
হচ্ছে খাল-বিল। উজাড়
হচ্ছে কৃষিজমি ও বন-জঙ্গল।
নষ্ট হচ্ছে কর্মক্ষেত্র ও বাসভূমির আশপাশের
পরিবেশ। কিন্তু এই সর্বনাশা বাস্তবতা
আমরা বোধ হয় সেভাবে
খেয়াল করছি না।
আমাদের
বোকা বানানো উন্নয়ন ধোঁকাবাজদের বচনে সান্ত্বনার বাণী
ছিল—শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন
করতে গেলে পরিবেশের একটু-আধটু ক্ষয়ক্ষতি তো
মানতেই হবে।
মানবিক
বিবেচনা বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধির নামেও ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা হতো, আংশিক
গোষ্ঠীপ্রীতি, কিঞ্চিৎ দুর্নীতি, যৎসামান্য বৈষম্য এবং কিছুটা মুদ্রাস্ফীতির
কশাঘাত সহ্য করতে হবে
জনগণকে; যদি তারা দেশকে
সিঙ্গাপুরের চেহারায় দেখতে চায়।
গণতন্ত্রহীন
পরিবেশে রচিত, লোভের সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত, দেশি-বিদেশি বাজপাখির
দ্বারা সুরারোপিত এবং পতিত ফ্যাসিবাদী
শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ‘চাটার দলের’ মুহুর্মুহু হুক্কাহুয়া আওয়াজে পরিবেশিত নীতিহীন, তালহীন, ছন্দহীন উন্নয়ন (!) সংগীত দেড় দশক পর
কোন প্রতিধ্বনি শোনাচ্ছে মানুষকে?
সেই
বিকৃত উন্নয়নের ফল—গণমানুষের আর্থিক,
রাজনৈতিক ও সামাজিক ভোগান্তি,
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অকার্যকর হয়ে পড়া এবং
দেশের সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয়। অথচ ঠিক উল্টো
ছিল তাঁদের বয়ান। তবে উদ্দেশ্য ছিল
অত্যন্ত খাঁটি—উন্নয়ন প্রকল্প থেকে টাকাপয়সা কামানো।
এটিই
প্রত্যাখ্যান করে জুলাই-আগস্ট
২০২৪–এর বিপ্লব। অনুমান
করতে পারি, ছাত্র-জনতার চাওয়া পরিবর্তনের অনুচ্চারিত প্রত্যাশার একটি হচ্ছে বাসযোগ্য
সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে
বাংলাদেশের শিশুদের বেড়ে ওঠার আয়োজন।
প্রাকৃতিক
ও মানুষের বাঁচার পরিবেশ মেরেও যাকে উন্নয়ন বলা
হচ্ছিল, তা ইতিমধ্যেই সচেতন
পৃথিবীতে অচল। বিবেকবান চিন্তাবিদ
ও শিক্ষিত শিল্পোদ্যোক্তারা জানেন, প্রকৃতি ধ্বংস করে কোনো দেশ
বা জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি টেকসই হওয়ার নয়।
বলতে
পারেন, ১৮ কোটি জনসংখ্যার
এবং ৫৬ হাজার বর্গমাইলের
এই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। তাই এই বদ্বীপে
মানুষের খাওয়া-পরা ও জীবনমান
উন্নয়ন এবং সুষ্ঠু বাস্তুসংস্থান—এই দুই আপাত
বিপরীতধর্মী বিষয়ের সহাবস্থান কী করে সম্ভব?
সৎ চিন্তা করলে বাংলাদেশের জন্য
এতে কোনো উভয়সংকটই চোখে
পড়বে না; বরং আমাদের
মানুষের জীবন–জীবিকা রক্ষার্থেই
পরিবেশ রক্ষায় অগ্রাধিকার পাবে।
এখানে
পরিবেশবিরোধী উন্নয়ন কার্যক্রম এবং ভোগের নিমিত্তে
চলমান হারে দূষণ সৃষ্টি
করতে থাকলে পুরো বাংলাদেশের বসবাসযোগ্যতা
হারাতে এবং আবাদযোগ্য জমি
ফুরাতে খুব একটা সময়
লাগবে না। আর এ
ধরনের বিপর্যয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন তরুণেরা,
বিশেষ করে জেন–জি
প্রজন্ম।
তাই
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে আবাদি জমি রক্ষা বিশেষ
উদ্যোগের দাবি রাখে। সে
জন্য অল্প জায়গায় অধিক
লোকের আবাসন এবং ঊর্ধ্বমুখী বিস্তার
হতে পারে যথোপযুক্ত নীতিকৌশল।
অবকাঠামো,
শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক এলাকা, সরকারি দপ্তর ও স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,
হাসপাতাল নির্মাণসহ প্রতিটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে (গ্রিন ডেভেলপমেন্ট)
সম্পন্ন করলেই হয়তো আমাদের রক্ষা।
যেহেতু
আমাদের মানুষ বেশি, জমি কম, তাই
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের নীতি
যেমন দূরদর্শী হওয়া চাই, তেমনি
জনসংখ্যাকে দেশে এবং পৃথিবীর
বিভিন্ন প্রান্তে কাজে লাগাতে এবং
নাগরিক হিসেবে তাদের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিতে মাস্টারপ্ল্যান ও তার যথাযথ
বাস্তবায়ন জরুরি।
মানুষের
টিকে থাকা ও উন্নতির
সংগ্রাম নিয়ে এক মজার
ধারণা দিয়েছেন, আমাদের প্রিয় নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের কূটনীতিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
কিশোর মাহবুবানী। তিনি তাঁর ‘ক্যান
এশিয়ানস থিংক’ (এশীয়রা কি ভাবতে পারে)
বইতে ১৯৯০-এর দশকের
বিশ্ব জনসংখ্যার (৫.২৫ বিলিয়ন)
আলোকে প্রশ্ন তুলেছেন, পরিকল্পিত নগর উন্নয়নের মাধ্যমে
বিশ্ববাসীকে তাঁর দেশের মতো
জীবনমান উপহার দিতে কতটুকু ভূমি
যথেষ্ট?
সিঙ্গাপুরের
মতো উল্লম্ব উন্নয়ন মডেল অনুযায়ী, সারা
বিশ্বের তখনকার জনগোষ্ঠীর একত্রে বসবাসের জন্য জায়গা দরকার
কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার সমান বা পৃথিবীর
মোট ভূমির ১০০ ভাগের মাত্র
১ ভাগ!
সেই
হিসাবে বাংলাদেশের বর্তমান অধিবাসীদের জন্য প্রয়োজন হবে
৩০টি সিঙ্গাপুর আকারের নগর। তাতে আরও
(সিঙ্গাপুরের) ১৭৭ গুণ ভূমি
অবশিষ্ট থাকবে।
এই
‘উদ্ধারকৃত’ ভূমি সুন্দরভাবে ব্যবহার
করা যাবে চাষাবাদ, শিল্প
বিকাশ, পর্যটন উন্নয়ন এবং বৈচিত্র্যময় পরিবেশবান্ধব
কর্মকাণ্ডের জন্য।
বাংলাদেশের
মানুষকে সুস্থ পরিবেশে সমৃদ্ধি দেওয়ার উপযোগী নানা প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই
বাজারে আছে; তবে অন্ধভাবে
সেগুলোর অনুকরণ না করে এ
দেশের পরিপ্রেক্ষিতে টেকসই আকারে ব্যবহার করাই হবে যুক্তিযুক্ত।
সে আঙ্গিকে নতুন ভূমি পাওয়ার
স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়? হিমালয়
অঞ্চল থেকে নদীবাহিত পলিমাটি
প্রযুক্তির সাহায্যে বাংলাদেশের জলসীমায় জমাট করতে পারলে
বঙ্গোপসাগরে ২৫ হাজার বর্গমাইল
এলাকা দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
সমুদ্রে
এই ভূমি উন্নয়ন সময়সাপেক্ষ
কিন্তু ততটা ব্যয়বহুল নয়
বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট
বিশেষজ্ঞরা। সে জন্য একটু
ধৈর্য রাখা এবং কার্যকর
ব্যবস্থা নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যথায়
সুনীল অর্থনীতি বিকাশের গালগল্প এবং জনমিতির অসীম
সম্ভাবনার মতো পরিবেশ রক্ষা
বা টেকসই উন্নয়ন নিয়ে আমরা আলোচনা
করতে বা শুনতেই থাকব
আজীবন।
যাহোক,
সমুদ্রে নতুন দেশ জেগে
না উঠলেও তো জাতি হিসেবে
আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হবে এবং তা
এই ভূখণ্ডেই।
আমাদের
ভৌগোলিক সীমারেখা বা তার বাইরে
বাংলাদেশিদের টিকে থাকা এবং
সুস্বাস্থ্যসহ সসম্মানে জীবনযাপন করার বিষয়টি শুধুই
পরিবেশগত আন্দোলন নয়; এটি ভবিষ্যৎ
অর্থনীতি, রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ও
বৈদেশিক নীতির ভাবনার বিষয়। অবিচ্ছেদ্য অংশ।








